বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে

আন্দালিব রাশদী:

রবীন্দ্রনাথ বিরহদহন দিয়ে জীবনটাকে এখানেই থামিয়ে দেননি। অনিত্য জীবন যত গুরুত্বপূর্ণ হোক মহাকালের চোখ দিয়ে দেখলে একটি বিন্দুর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এই বিন্দুগুলো যখন তার আগের ও তার পরের বিন্দুর সঙ্গে শেকলে বাঁধা পড়তে থাকে, তখন সৃষ্টি হয় বিন্দুর অনন্ত রেখা। সে কারণেই কি রবীন্দ্রনাথ ঠিক পরের পঙ্ক্তিটিতে লিখেছেন ‘তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে’।

দুঃখই বয়ে এনেছে করোনাকালের এই মৃত্যুসংবাদ। চুয়াল্লিশ বছর আগে দৈনিক বাংলার ভবন থেকে বেরিয়ে তিনি হাতে ধরে টেনে রিকশায় তুললেন এবং বললেন, পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রশ্ন : ‘দেশ কোথায়?’ এই দেশ মানে বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান নয়, এর মানে নোয়াখালী না চট্টগ্রাম, খুলনা না যশোর, রংপুর না দিনাজপুর। সে হিসেবে বাংলাদেশের ভেতর সতেরোটি দেশ, তারপর উনিশটি দেশ, তারপর চৌষট্টিটি। তিনি বললেন, তোমার-আমার দেশ মিলে গেছে। বাংলাদেশ টাইমসের জন্য হাতে লেখা একটি গ্রন্থ আলোচনা তার টেবিলে যখন রাখি, জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়ো? বাবার বাড়ি কোথায়? জবাবে বলি, কেবল কলেজ ছেড়েছি, আমার বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিন্তু তার কিংবা তার বাবার বাড়ি কোথায়, জিজ্ঞেস করাটা কেবল লিখতে শুরু করা নবিসের জন্য সমীচীন হবে না বলে চুপ করে থাকি। আসলে তিনি তখনই বেরোচ্ছিলেন।

বললেন, ভেবেছিলাম রিকশা থেকে তোমাকে তোমার সুবিধাজনক কোনো জায়গায় নামিয়ে দেব। কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না। আমরা এক দেশের মানুষ, সুতরাং আমরা তো ‘খেশি’ করতেই পারি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষা ‘খেশি’ মানে আত্মীয়তা। প্রথম দিনই খেশি তার সঙ্গে তার বাসায় গিয়ে ভাত খাওয়ায় অংশগ্রহণ করি। এর চেয়েও বেশি আনন্দ জোটে দুই মাস পর। লেখার বিল তুলতে গিয়ে পাই ষাট টাকা অবজারভারের চেয়ে দশ টাকা বেশি। খটকা লাগল, টাকা হাতে নিয়ে বলতে এলাম দশ টাকা বেশি দিয়েছে। তিনি বললেন, যদি ভুলে দিয়ে থাকে তাহলে আজকেই লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’টা কিনে ফেলো। বয়স বেড়ে গেলে এটা পড়তে তত ভালো লাগবে না। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো তখন বলতে হবে এইটা বাজে বই। আমি বললাম, দুই বছর আগেই পড়েছি, আমার কাছে আছে। তিনি বললেন, তাহলে তো দুই বছর আগেই পেকে গেছো। আশির দশকের গোড়ার দিকে জানলাম, আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি দেশাত্মবোধক গান তারই লেখা : ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়/ হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে/ যায় জুড়িয়ে/ ও আমার বাংলা মা গো। সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে গানটি এমনিতেই শরীরে শিহরণ এনে দেয়, ষড়্ঋতুর এমন জীবন্ত বর্ণনা আর কোনো গানে আমি শুনিনি। আমি এত দিন ভুল জেনে এসেছি আমি তো জেনে এসেছি, নিশ্চয়ই ডি এল রায়ের গান। কিন্তু কেন জেনে এসেছি তার কোনো সংগত ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। এ গানটি লিখেছেন আবুল ওমরাহ মোহাম্মদ ফকরুদ্দীন, কী আশ্চর্য! তার সঙ্গে আমার চেনাজানার পাঁচ বছর হয়ে গেল, তবু জানি না। আমার পরিচিত আরও অনেকে নিজের

সুকৃতির কথা শুনতে বাধ্য করেন। অথচ ফকরুদ্দীন ভাই! হন্তদন্ত হয়ে ফকরুদ্দীন ভাইয়ের কাছে হাজির হলাম। আমি আমার বিস্ময়ের ও প্রকৃত গীতিকার আবিষ্কারের কথা বললাম। যারা তার বন্ধু ও প্রিয়জন, তারা তার কথা বলার ধরনটা জানেন। তিনি নাটকীয়ভাবে বললেন, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমার ভাবিকে এবং তোমাদের লুকিয়ে আমি একটা বিয়ে করে ফেলেছি আর তুমি সেটাই আবিষ্কার করেছ। যথারীতি বললেন, আমি ওয়াকওভার দিয়ে দিয়েছি। আমি জিজ্ঞেস করি, কাকে? তিনি বললেন, অন্য গীতিকারদের। তারপর হেসে উঠে বললেন, আমি গীতিকার হিসেবে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করতে পারিনি, অসুবিধে নেই।

২৪ অক্টোবর ২০২০ ফকরুদ্দীন ভাই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে লকডাউন শুরু হওয়ার মাত্র কদিন আগে ঠিক চুয়াল্লিশ বছর আগে যেমন টেনে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন, একইভাবে শংকর বাসস্ট্যান্ড থেকে টেনে টেনে আমাকে ধানম-ি ১৫-তে ইবনে সিনা হাসপাতাল লাগোয়া একটি কি দুটি বাড়ি পরে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। অনেক বছর পর ভাবির সঙ্গে দেখা। তিনিই বললেন, আমাকে আগে তুমি সম্বোধন করতেন না আপনি মনে করতে পারছেন না। আমি বললাম, তখন তো তুমি বলতেন, এখন যদি আমাকে আপগ্রেড করতে চান তাহলে…।

আমার আপগ্রেডেশন আর হয়নি। ভাবি সাংবাদিকতার প্রিয়মুখ মমতাজ বিলকিস বানু। উইমেন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। ভাবি তার সম্পাদিত বিজয়িনীর বেশ কটা সংখ্যা দিলেন। ফকরুদ্দীন ভাই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি দুর্লভ গ্রন্থের সদ্য ফটোকপি করা একটি কপি আমাকে দিয়ে বললেন, ফেরত দিতে হবে না, একেবারেই স্বত্ব ত্যাগ করে দিয়ে দিলাম। তারপর যে কাজটি করলেন, তার বয়সী আমার প্রকৃত কোনো অগ্রজ থাকলেও করতেন না। তিনি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও সাতমসজিদ রোড পার হয়ে রাস্তার ওপারে শংকর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসবেন এবং সত্যিই এলেন এবং বললেন, তোমাকে যেখান থেকে নিয়ে গিয়েছি, সেখানে আবার রেখে গেলাম, বাকিটুকু তোমার নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে ফোন করে আমাকে আশ্বস্ত করবে যে তুমি স্ত্রী ও সন্তানের কাছে পৌঁছেছ। তিনি বেশ কিছুকাল ইনডিপেনডেন্ট-এ কর্মরত ছিলেন। সুতরাং আমিও লিখতে শুরু করি এবং ‘দশ টাকা’ বেশি না হলেও কিছু সম্মানী তো আশা করি। তারপর জানলাম তিনি বিল ঠিকই করেছেন, কিন্তু সম্পাদক সাহেব তার দু-একজন বন্ধু এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় এমন কয়েকজন বাদে অন্যদের সম্মানী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, আপনাকে সম্মানী দেবই এমন কোনো চুক্তি কি আপনার সঙ্গে আমার হয়েছে? না, সম্পাদকের সঙ্গেও হয়নি, সহসম্পাদকের সঙ্গেও না। উপসম্পাদকীয় লিখলে সম্মানী পাওয়া যাবে না, এমন সিদ্ধান্তও নেই। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি তার পাওনা কড়ায়-গ-ায় বুঝে নিলেও তার সহকর্মী ও লেখক অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সম্পাদক পরবর্তী সময়ে উপদেষ্টাও হয়েছেন।

যারা এ ইউ এম ফকরুদ্দীনের ইংরেজি গদ্যের সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন শুধু ভালো ইংরেজি জানাই তার লেখার রস-আস্বাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাকে বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলার কাহিনী যেমন জানতে হবে, তেমনি টি এম এলিয়টে তার জানা থাকতে হবে এপ্রিল কেন নিষ্ঠুরতম মাস। আমি তার মুখেই প্রথম পণ্ডিতদের রাজ্যে আকালের একটি কৌতুক শুনি : লেখা ছাপা না হওয়াতে একজন অসন্তুষ্ট আমলা তাকে বলেছেন, আপনি কত বড় পণ্ডিত, আমার জানা আছে। জবাবে তিনি তাকে কী বলেছেন, বলেননি। তবে তিনি আমাকে বলেছেন : ‘সক্রেটিস মারা গেছেন, প্লেটো মারা গেছেন, অ্যারিস্টটল মারা গেছেন, এমনকি কার্ল মার্ক্সও মারা গেছেন। পণ্ডিতদের রাজত্ব আর বোধ হয় থাকবে না, সকাল থেকে আমার বুকটাও কেমন ধড়ফড় করছে।

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার দুর্লভ গুণের অধিকারী তিনি। বেশ বলেকয়ে একবার তাকে আমার তৎকালীন কর্মক্ষেত্রটি দেখতে যেতে বাধ্য করি। কর্মক্ষেত্রটি একদা গভর্নর হাউজ নামে পরিচিত ছিল, এখন বঙ্গভবন। দুধে-আলতা গায়ের রং সুদর্শন মানুষটি এমনিই আকর্ষণীয়, রুচিসম্মত পোশাকও পরতেন। তিনি এসেই আমাকে বললেন, আমাকে কি আজকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে? আমি কী জবাব দেব, তা নিয়ে যখন দ্বিধান্বিত ছিলাম, তিনি বললেন, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আসার সময় তোমার ভাবি একটু সন্দিহান চোখে তাকিয়েছেন তো, তাই জিজ্ঞেস করছি।

ফখরুদ্দীন ভাই আমার একটি লেখা ছেপেছিলেন, তা শুরু হয়েছিল একটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কৌতুক দিয়ে। ব্রিটিশ বাবা, মা ও কৌতূহলী বালক পার্লামেন্ট ভবন পরিদর্শন করছে। তখনই অধিবেশন শুরুর ঘণ্টা অবিরাম বাজতে শুরু করে। বাবা জিজ্ঞেস করে, কীসের ঘণ্টা? বালক বলে, এমপিদের কেউ পালিয়েছেন। বালক একেবারেই নির্দোষ, নিষ্পাপ। এমপিদের মর্যাদা খাটো করার জন্য সে এ কথা বলেনি। পাগল পালালে পাগলাগারদের ঘণ্টা কেমন করে অবিরাম বাজে, তা সে জানে। এখানেও তা-ই ভেবেছে। এ লেখাটি তিনি ১৯৯৯ সালে ছাপেন। তারপর আকস্মিকভাবে যখন দেখা হয়েছে, তিনি জিজ্ঞেস করেছেন : এমপি সাহেব কি ধরা পড়েছেন? যাদের সান্নিধ্যে আমি একই সঙ্গে আনন্দিত ও আলোকিত বোধ করেছি, তাদের অন্যতম ‘ও আমার বাংলা মা গো’ গানের গীতিকার আমাদের অনেকেরই প্রিয় ফকরুদ্দীন ভাই। ২০০৭ সালে তিনি আমাকে বললেন, এ মুহূর্তে দেশে গণ্য করার মতো মানুষ আছেন তিনজন : চিফ অ্যাডভাইজার ফকরুদ্দীন আহমেদ, ফকরুদ্দীন বাবুর্চি, আর এ ইউ এম ফকরুদ্দীন। এমন রসিকতা তাকেই মানায়।সূত্র:দেশ রূপান্তর।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION